জেনিফার



শিবব্রত গুহ

"একি জেনিফার! তুমি এইখানে, আমি যে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। এও কি সম্ভব! " - বিস্ময়ের সাথে কথাগুলো বলে ফেলল উদিত।

" উদিত, আমার উদিত, আমি কতদিন পরে আবার, আবার, তোমাকে দেখতে পেলাম।
আমার, শুধু আমার উদিত।" - একনিঃশ্বাসে
বলল জেনিফার। তারপর, সে যা করলো
তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না উদিত।
জেনিফার উদিতকে বুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। উদিত তো হতবাক। সে কি যে করবে,
কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না!

এদিকে, উদিতের বাড়ি যেখানে, তা হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার তেহট্টে। তেহট্ট একটি মফঃস্বল শহর। রবিবার সকালে, সবে
বাজারের থলিটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে,
এমন সময়, হঠাৎ করে এই কান্ড! এদিকে চারিদিকে লোক জমে গেল। সবাই মুচকি মুচকি
হাসতে লাগলো। অনেকে আবার নানা রকমের
মন্তব্য ছুঁড়ে দিল। উদিতের এসব ভালো লাগছিল
না।

সে আস্তে করে বলল, " জেনিফার, জেনিফার,
প্লিজ, প্লিজ, আমাকে এবার ছাড়ো, প্লিজ।"

জেনিফার ধাতস্থ হয়ে উদিতকে বলে, " কেন? কেন? তুমি আমাকে এত দুঃখ দিলে? কেন উদিত?" - একথা বলে জেনিফার হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করে দিল।

উদিত আবার বিপদে পড়ে গেল। সে জেনিফারের
চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, " তুমি এরকমভাবে মড়া কান্না কাঁদছো কেন জেনিফার?
প্লিজ তুমি আর কেঁদো না। "

জেনিফার এবার রাগতস্বরে বলে, " তুমি গত তিন
মাস ধরে কেন আমার সাথে কোন যোগাযোগ করোনি? কেন? কেন? কি আমার অপরাধ? "

উদিত উত্তেজিত হয়ে বলল, " তুমি তো আমাকে যা না তাই বলেছিলে তোমার WhatsApp -এ।
তোমার মনে নেই সেসব? "

জেনিফার অবাক হয়ে বলে, " এসব তুমি কি বলছো উদিত? আমি বলেছি? আমি? "

উদিত রাগতস্বরে বলল, " হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বলেছো।
আরো আরো অনেক খারাপ খারাপ কথা তুমি আমাকে বলেছো।"

জেনিফার বিস্ময়ের সাথে বলে, " আমি বলেছি?
আমি? তা কখনো হতে পারে না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি উদিত, I Love You."

উদিত ঘৃণার সুরে বলল, " না, না,তুমি আমাকে ভালোবাসতেই পারো না। একজন ব্রিটিশ নারী
কখনো একজন ভারতীয় যুবককে ভালোবাসতেই
পারে না। এ অসম্ভব। এ সব তোমার অভিনয়। "

জেনিফার উত্তেজিত হয়ে বলে, " না, না, এ আমার অভিনয় নয়। সত্যি বলছি, আমি কখনো
তোমাকে এসব কথা বলিনি। আমি যদি তোমাকে ভালো না বাসতাম, তাহলে, উদিত, তোমার জন্য,।শুধু তোমার জন্য, সেই সুদূর ব্রিটিশ মুলুকের
রাজধানী লন্ডন থেকে ছুটে আসতাম ভারতে তোমার কাছে, সবকিছু ছেড়ে। ভেবে দেখো একবার? "

উদিত হাত নেড়ে বলল, " আমার ভাবার আর কিছু নেই। আমার আর তোমাকে বলার কিছু নেই।"

জেনিফার অবাক হয়ে বলে, " একি কথা বলছো
তুমি উদিত! আজ থেকে দুই বছর আগে, তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, ফেসবুকে। তারপর, তোমার আর আমার বন্ধুত্ব রূপান্তরিত হয় প্রেমে। কত রাতের পর রাত, দিনের পর দিন,
আমরা দুজনে কথা বলেছি, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে,
হোয়াটসঅ্যাপে, সেসব কথা কি তুমি কি ভুলে গেছ? ভুলে কি গেছ উদিত? মনে কি পড়ে না সেসব কথা? আমরা একসাথে সারাজীবন কাটাবো, এই প্রতিজ্ঞাই তো করেছিলাম, তাই না? "

উদিত রাগতস্বরে বলল, " না, না, আমার মনে নেই
সেসব কথা, আর মনে রেখেই বা কি লাভ! সব সম্পর্কই তো চুকেবুকে গেছে, তোমার আর আমার
মধ্যে। আমাদের মধ্যে, আর কোন, কোন সম্পর্ক
নেই, সব শেষ হয়ে গেছে, আর তার জন্য দায়ী তুমি, জেনিফার শুধু তুমি।"

জেনিফার উদিতের হাত দুটো ধরে বলে, " প্লিজ
উদিত, এসব কথা আর তুমি আমাকে বোলো না
, আমি যে তোমায় ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি।
তোমায় ছাড়া বেঁচে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারি না। তুমি ভুলে যেও না, যে, আমার বাবা ব্রিটিশ হলেও, আমার মা কিন্তু একজন
তোমার মতো বাঙালী। তাঁদেরও লাভ ম্যারেজ।
আমি আমার মায়ের থেকে সব বাঙালী সংস্কার পেয়েছি। "

উদিত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, " দেখো, এটা তোমার লন্ডন নয়, এটা ভারত। সবাই আমাদের দেখছে। শুধু শুধু সিনক্রিয়েট নাই বা করলে,
বুঝলে কিছু? "


জেনিফার অবাক হয়ে বলে, " উদিত, তুমি গত তিন মাসে, এতটাই বদলে গেছো, আমি তো ভাবতেই পারছি না? "

উদিত হাত নেড়ে বলল, " আমিও ভাবতে পারিনি,
যখন তুমি আমাকে WhatsApp -এ - গালাগালি দিয়েছিলে, আমার জাত তুলে, আমার দেশ ও দেশবাসীর নামে যা না তাই বলেছো, আমার পরিবারকেও তুমি ছাড়োনি। "

জেনিফার রেগে বলে, " আমি এসব কিছুই বলিনি,
বলেছে, আমার বোন স্টেলা। "

উদিত অবাক হয়ে বলল, " স্টেলা! ও এরকম করেছে! ওর সাথে তো বার দুয়েক তুমি কথা বলিয়েছো ভিডিও কলে, WhatsApp - এ।
ও কেন এরকম করলো? কেন? আমি জানতে চাই।"

জেনিফার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে চলে, " তুমি উদিত, স্টেলাকে ঠিক চিনতে পারো নি, আমিও
পারি না। ওর বাইরেটা যতটা সুন্দর, হাসিখুশি,
ওর ভেতরটা ঠিক, ততটাই কদর্য। ও খুব নাকউঁচু এক ব্রিটিশ নারী। ও বিশ্বাস করে বর্ণবৈষম্যে।
ও একদম পছন্দ কর‍তো না তোমাকে। প্রথম প্রথম,
অবশ্য বাইরে থেকে ও কিছু সেসব বুঝতেই দিত না। ও খুব চালাক মেয়ে। ও চাইতো মনে মনে, তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাক। ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সেই সুযোগটা ও পেয়েই গেল অবশেষে। "

উদিত হতবাক হয়ে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বলল, " কি সুযোগ? "

জেনিফার একটু দম নিয়ে বলে, " শেষ যেদিন তোমার সাথে আমার কথা হয়েছিল, সেই দিনটা ছিল রবিবার। সেদিন অনেক রাত অবধি আমি
তোমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছিলাম।
পরদিন, সকালে, আমার ঘুম ভাঙতে খুব দেরী হয়ে যায়।, আমি তাড়াতাড়ি করে স্কুলে
চলে যাই পড়াতে। কিন্তু, ভুল করে আমার মোবাইলটা বাড়িতে ফেলে যাই। এই একটা ছোট ভুল যে আমার জীবনে এতবড় একটা ঘটনা ঘটাবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি উদিত।"

উদিত বড় বড় চোখ করে বলল, " সেকি, এরপর কি ঘটলো? "

জেনিফার শান্তভাবে বলে, " আমি স্কুলে গিয়ে বুঝতে পারলাম, যে আমি ফোনটা ফেলে এসেছি বাড়িতে। কি আর করা যাবে? আমার বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেখানি। বিকালবেলা, আমি
যথাসময়ে বাড়ি ফিরে দেখি, যে, আমার মোবাইলটা আমার পড়ার টেবিলে, যেভাবে ফেলে গেছি, সেভাবেই পড়ে আছে। শুধু মোবাইলে নেই
চার্জ। আমি মোবাইলটা চার্জে দিলাম। রাতে, যখন, আমি তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি,
তখন আমি কোনভাবেই তোমার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমি তো অবাক হয়ে যাই। তুমি কখনো তো এরকম করোনি এর আগে। আমি যখন চেয়েছি তোমার সাথে কথা বলতে পেরেছি, তখনই। তবে, আজ, কি হল? আমি বুঝতে পারলাম, যে, তুমি আমায় সবজায়গাতে, করে দিয়েছো ব্লক। আমি হাউহাউ করে কেঁদে ফেললাম। আমাদের এই মধুর ভালোবাসার সম্পর্ক কি তাহলে এখানেই শেষ হয়ে গেল চিরকালের মতো?

আমি কি করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
তারপর, ঠান্ডা মাথায়, ভাবতে ভাবতে আমার পুরো সন্দেহ গিয়ে পড়লো স্টেলার ওপরে।
তোমাকে একটা কথা আমার আগেই বলা উচিত ছিল। কিন্তু, আমি বলিনি। তবে, এখন মনে হচ্ছে,
যে, বলে দিলে ভালো হতো। প্রকৃত ভালোবাসায় কোন কথা গোপন করতে নেই। আমি করেছিলাম, তার জন্য, তুমি আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও, উদিত।

স্টেলার এক বন্ধু পিটারের দাদার নাম হল ডঃ জোনাথন গোমজ। তার আমাকে খুব পছন্দ হয়ে যায়। সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি সরাসরি তাকে না বলে দিই। এতে, স্টেলা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আমার ওপরে। ইদানিং ওর, আচার আচরণ কিরকম বেঠিক লাগছিল আমার কাছে।
ও বারবার আমাকে সোজাসুজি পীড়াপীড়ি করছিল, জোনাথনকে বিয়ে করার জন্য। আমি কিন্তু কিছুতেই রাজি হয়নি।

আমি মোবাইল কখনও লক করে রাখি না। তুমি কিন্তু আমাকে বারবার বলতে, মোবাইল লক
করে, রাখার জন্য, আমি শুনিনি। যদি শুনতাম, তাহলে, আমাকে এত দুর্ভোগ পোহাতে হত না। যাইহোক,
আমি পরদিন, সকালে, স্টেলাকে চেপে ধরি।
ও প্রথমে স্বীকার না করলেও, পরে সব সব স্বীকার করে। আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে,
স্টেলা আমার এতবড় সর্বনাশ করবে, তা আমি
কখনো ভাবিনি, কখনো না। তারপর, আমি সবকিছু ফেলে, সব ত্যাগ করে ছুটে এসেছি তোমার কাছে, উদিত। আমার কাছে স্বীকারোক্তি আছে স্টেলার।

আমি আমার মোবাইলে সেই স্বীকারোক্তি ভিডিও করে রেখেছি। " - এরপর, জেনিফার ওর জিন্সের
প্যান্টের পকেট থেকে ওর দামী মোবাইলটা বের করে উদিতকে সেই স্টেলার স্বীকারোক্তির ভিডিওটা দেখায়। উদিত সব বুঝতে পারে।

জেনিফার এবার বলল, " এখনো কি তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো উদিত? তুমি আমাকে আর দূরে সরিয়ে রেখো না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা, উদিত।
I Love You From Heart. আমাকে তুমি
ক্ষমা করে দাও প্লিজ, উদিত, প্লিজ। "

- একথা বলে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জেনিফার উদিতের পায়ের কাছে পড়ে গেল।
উদিত আর থাকতে পারলো না। সে কিন্তু মনে
মনে জেনিফারকে খুব খুব ভালোবাসে।

উদিত জেনিফারকে নীচ থেকে ওপরে তুলে,
তার চোখের জল, মুছিয়ে দিয়ে বলে, " আর কেঁদো না প্লিজ। আমি সব বুঝতে পেরেছি।
আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। তুমি পুরোপুরি নির্দোষ। জেনিফার, তোমার ভালোবাসা খাঁটি,
একদম খাঁটি। আমি তোমাকে বিয়ে করে সারাজীবন আমার হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে রাখবো।
I Love You. "

উদিত আর জেনিফার, একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। সত্যিই, ভালোবাসার টান একেই বলে!

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(0)

গল্প পড়ুন, গল্প লিখুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার গল্প তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
CLOSE