Select language to read news in your own language


গল্পটি পড়ুন এবং আপনার লেখা গল্প Upload করে অন্যকে পড়ান। SatSakal Facebook Page টি লাইক করে সঙ্গে থাকুন।


বুড়িটা বোঝেনি সে কথাগুলো!



তন্ময় সিংহ রায়                                         

এ গ্রহের উদ্ভিদ গুনে গুনে বড়জোর আর ক'টা দিন অক্সিজেন দেবে তাঁকে।
বিভিন্ন প্রসাধনীতে যে ত্বক একদিন ধরে রাখতো তাঁর লাবণ্য ও কোমলতা ,  
বেশ বহু বছর হল শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করেছে সে। 
অসংখ্য ভাঁজের ভীড় ও কোলাহলে 
সে (ত্বক) চিরতরে হারিয়েছে সেই স্বাভাবিক রূপ! 
শিরা ধমনীগুলোও যেন প্রতি মুহূর্তে 
উপেক্ষা করে তাঁকে , কথা শোনে না একেবারেই।
যে শান্ত , স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে ছিল পরম মমতার কোমল স্পর্শ , সে দুর্বল দৃষ্টি আজ চরম অনাদর ও অবহেলায় প্রায়ই ভেসে থাকে নোনাজলে।  
ক্ষীণ হৃদপিণ্ডটাও আজকাল যেন কেবলই বকে চলে পাগলের প্রলাপ।
শক্তিহীন পা'দুটোও কেমন যেন টেনে-হিঁচড়ে কোনোরকমে পালন করে ভারসাম্যহীন একটা শরীরের কর্তব্য।     

কতবার মন গর্ভে জন্ম নিয়েছে এক দৌড়ে পৌঁছে যেতে সেই অশ্বত্থ গাছের তলায় , যেটা ছিল তাঁর একমাত্র জীবন সঙ্গীর ভীষণ প্রিয়।
জীবনের নানান জটিলতা ও ব্যস্ততার জঙ্গলকে পেরিয়েও যে গাছের নিচে একান্তে মিলিত হত সে তাঁর একমাত্র ভালোবাসার মানুষটার সাথে। 
হাতে-হাত ও চোখে-চোখ রেখে সে কত কথা , জন্ম দেওয়া কত স্বপ্নের , আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভরসার?     
মনে পড়ে একবুক আশা নিয়ে তাঁর প্রিয় মানুষটার বলা সেই কথা , 
'আমি যদি চিরকালের মতন চলে যাই তোমাদের ছেড়ে আগে , আমাদের ছেলেকে কিন্তু বুকে করে আগলে রেখো নিরুপমা!'       
কতবার মনে হয়েছে জীর্ণ-শীর্ণ   
কাঠের আলমারির প্রথম তাকে রাখা 
তাঁদের একমাত্র আদরের ধন ছেলেটার সেই ছোট্টবেলার কাজল টিপ পরানো ছবিটাকে আর একটু ছুঁতে!
কিন্তু জীবনের অন্তিম লগ্নের বুকে দাঁড়িয়ে এই আশাগুলোই কেমন যেন বন্দী হয়ে অসহায়ভাবে , দিগভ্রান্ত হয়ে শুধুই দৌড়ে বেড়িয়েছে সমগ্র মন জুড়ে একটু মুক্তি পাওয়ার জন্যে!

আজ প্রায় বছর দেড়েক হল ,  
প্রতিদিন বিকেল ঠিক চারটে বাজলেই বুড়িটা জানালাটার লোহার রডগুলোকে ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে ওই মাঠের দিকে! 
সব প্রশ্নের উত্তর পেলেও , তখনও পাওয়া যায়নি এ প্রশ্নের কোনো সমাধান।
'ঠিক বিকেল চারটে বাজলেই কেন তিনি তাকিয়ে থাকেন এভাবে ওই মাঠের দিকে?'
কৌতুহলদীপ্ত জনা-তিনেক বৃদ্ধা'র জানার প্রবল ইচ্ছেকে লুকোতে না পেরে অবশেষে একদিন বুড়িটা বলেই বসে , 
তাঁর একমাত্র আদরের সোনার টুকরো জীবন ,  ছোট্ট ছেলেটা নাকি ভীষণ চঞ্চল।
কোথায় খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বিষম চোট পায় , রক্ত বের হয় কেটে গিয়ে , কি যে করে বসে?   
তাই প্রতিদিন খেলার সময় তিনি ছেলেকে অস্পষ্ট কিন্তু নিষ্পলক দৃষ্টিতেও , দুর্বল রেটিনায় বসিয়ে নাকি করে রাখেন নজরবন্দী।

পরম মমতার এরূপ মর্মান্তিক প্রতিফলনে বিষ্ময়ে হতবাক চশমাবৃত ছ'টা চোখের ভাঙাচোরা অশ্রুগ্রন্থি , নিঃসৃত করেছিল কিছু পরিচিত বেদনাশ্রু!
বোঝানোর সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম সত্বেও সে বুড়ি বোঝেনি যে , তাঁর সোনার টুকরো সেই ছেলে আজ প্রাপ্তবয়স্ক। 
বিয়ে করে একটা বউকে এনেছে সে 
ঘরে ,  
আর বউয়ের অপছন্দটা ছেলের কাছে আজ তাঁর চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান।
আর সে কারণেই , মূল্যটাকে হীন করে  প্রাণহীন ও অব্যবহৃত আসবাবপত্রের মতন তাঁকে রেখে দিয়ে গেছে এই ঘরেই তাঁদের (অন্যান্য বৃদ্ধাদের) সাথে! 

তাঁর শেষ জীবনের ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া-পাওয়া ,  আশা , আকাঙ্ক্ষা , স্বপ্ন , ভরসা সব'ই তাচ্ছিল্যে ছেলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে এই আবদ্ধ ও প্রাণহীন ইঁটের খাঁচায়! 
বুড়িটা বোঝেনি যে , আজ আর তাঁর হৃদপিন্ড  ছেলেটা রাতে দুধের জন্যে ডুকরে ওঠেনা কেঁদে , তাঁকে আজ আর যে পরাতে হয়না পরম ভালোবেসে সেই কাজল টিপ! 
ছোট্ট আঙুলটা ধরে অতি যত্নে গুটি গুটি পায়ে সে আর হাঁটেনা মায়ের সাথে!
স্কুল থেকে এসেই ঝপাস করে ব্যাগটা ফেলে অভুক্ত মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আজ আর ওঠেও না বলে ,  'মা গো খিদে পেয়েছে , ভাতটা মেখে খাইয়ে দাও মা!'
তখন সে ছিল অবুঝ , আর আজ এ পৃথিবীর অনেক কিছুই ছেলে বোঝে যে , আর তাইতো সে (বুড়ি) এখানে।
বুড়িটা বোঝেনি সে বোঝানো কথাগুলো।                                                           

একদিন গহীন রাতে , আতঙ্কিত দৃষ্টিতে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে বুড়িটা চিৎকার করে বলে উঠলো , 'সোনা আমার , ওদিকে যাসনা বাবা...  
ওদিকে পুকুর আছে....!'

সেই জানালা , ছবি ও অশ্বত্থ গাছটা তেমনই আছে , আছে দিগন্ত বিস্তৃত সেই খোলা মাঠটাও। 
কিন্তু শুষ্ক চামড়ার মায়া-মমতা ও স্নেহ-ভালোবাসা জড়ানো সেই দুটো হাত বিকেল চারটে-তে আর কোনোদিনও ধরেনি লোহার রডগুলোকে সেদিনের পর!

ads banner
Share the content if you like it.