অবনিতা



অনির্বাণ চক্রবর্তী 

শুক্রবার সকাল বেলা। আমার একহাতে চল্লিশ সাইজের দুইখান এপেক্স সু। অন্যহাতে বোগলদাবা করে নেওয়া দশাধিক জামাকাপড়। কাজ হলো জুতা দুইখান মুচির দোকানে রেখে, জামাকাপড় লন্ড্রিতে দিয়ে আমি বসে পরবো সেলুনের দোকানে। গাল ভর্তি দাড়িগোঁফে। এমনকি মাথার চুলগুলোতে ইচ্ছা করলে রাবারে প্যাঁচানো যায়। এজন্য নরসুন্দরের ওখান থেকে নিজে পরিস্কার হয়ে, ইস্ত্রি করা জামাকাপড় আর মুচির দোকানের কালি করা জুতা নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে। 

হঠাৎ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। এই মুহুর্তে মোবাইল রিসিভ করা যে কতটা বিরক্তিকর, তা আমার মতো যে ভুক্তভোগী শুধু তিনিই জানেন। আমি হাতের জুতা দুইখান কান রাস্তার একপ্রান্তে রেখে ফোনটা ধরলাম। 

বন্ধু, কেমন আছো?  

কেমন আর আছি। ছোটবেলা থেকে বিরক্ত করার সময়টা আর তুই ভুলতে পারলি না। 

কেন? কি হয়েছে? ঘরে তো তোর বউ নাই। বিশেষ কোন সময়ও তো তোর থাকার কথা না। 

ধুর শালা ফকির কোথাকার।  আমার একহাতে জুতা আছে। আয় দুইটা চটকানি দিয়ে দেই। অন্যহাতে একগাদা কাপড়চোপর। লন্ড্রিতে যাচ্ছি।
 
বন্ধু, তুই সাতক্ষীরা ডেয়ারিতে একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি। 

ঢাকা থেকে ফিরলি কবে? 

এই তো গাড়ি থেকে এখনো নামতে পারি নি। তুই পাঁচ মিনিট দাঁড়া। আমি দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবো। হাহাহা। 

ফোনটা কেটে দিল। ফকির কোথাকার। 

ফোনটা ছিল বন্ধু সেফায়েত ফকিরের। ও এখন ঢাকার একটা বেসরকারি এয়ারলাইন্সে জব করে। টাকা পয়সায় সে যেন ফুলে ফেঁপে উঠছে। ওকে এই মুহুর্তে ফকির বলাটা আমার সত্যিই ভুল হয়েছে। আমি ফোনটা পকেটে রাখতে না রাখতেই দেখি, আমার একটা জুতাকে একটু দূরে বসে একটা বাচ্চা কুকুর কামড়াচ্ছে। ওকে অন্য জুতাটা দেখিয়ে তেড়ে আসতেই কুত্তারবাচ্চা জুতা ফেলে দৌড়।

আমি সাতক্ষীরার ঘোষ ডেয়ারিতে ঢুকতেই চোখে পরলো, একটা সাড়ে পাঁচফিটের উপরে লম্বা সুশ্রী মেয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি মেয়েটাকে টপকে ভিতরে প্রবেশ করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। কাপড়চোপড়গুলো রাখলাম আমার হাটুর উপরেই। হাতের জুতাজোড়া রাখলাম টেবিলের কর্নারে। চেয়ার টেবিলে বসতে না বসতেই ডেয়ারির একটা ছেলে আমাকে একপ্লেট দই দিয়ে গেল। বলা নাই, কওয়া নাই, অর্ডার নাই তবুও আমি ওর দই দেওয়া দেখে একটুও বিচলিত হলাম না। কারন আমি এই সাতক্ষীরা ডেয়ারিতে মাসে অন্তত দুই একবার আসি। ওদের বলতে হয় না। ওরা আমাকে একপ্লেট দই দেয়। এখানে কাপদইও রয়েছে। ওটা দেয় না। দেয় ঠিক এই কাটা চামচের দই। আমি দই খেয়ে বিল মিটিয়ে প্রতিনিয়ত চলে যাই। 

বাঙলায় একটা প্রবাদ আছে। 'নিজের সইলেও প্রতিবেশির সয় না।' জানি না এই প্রবাদটি কি কারনে তৈরী হয়েছিল। আমি অকপটে খাচ্ছি দেখে ওই লম্বা মেয়েটা আমার সামনে থেকে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো তিনি হিসাবে মেলাতে পারছেন না। নয়তো মনে হচ্ছিল যেন আমি ওর বাপের টাকায় খাচ্ছি। নতুবা অন্য কিছু। মেয়েটির আমার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে আমিও তার আপাদমস্তকে আরও একবার চোখ বুলাতে গেলেই সে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওড়নাটা এটেসেটে টেনে ঠিক করে নিল। মেয়েদের ওড়না পড়া দেখে আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধুর কথা মনে পড়লো। ও বলতো, 'কাম নাই তাই ওড়না ঠিক কর।' এই মেয়েটি আসলেই বর্ণনাতীত সুন্দরী। আমি নিশ্চিত এই মেয়ের স্বামী বাসর রাতে ওর পূর্ণিমার রুপ দেখে নির্ঘাত প্রথমে মূর্ছা যাবে। এই মুহুর্তে মনে মনে আমি মেয়েটির নামকরণ করলাম। আমি তার নাম দিলাম অবনিতা। এরপর আমি আবারও খুব আস্তে আস্তে নিচু হয়ে খাবারে মন দেই।

অবনিতা ছয়কেজি মিষ্টি কিনেছে। ওর সাথে একটা বাচ্চা রয়েছে। দেখেই বোঝা যায় নিজের না, অন্যের। নয়তো দত্তক নেওয়া। পাশে বসে ওদের কথার আলোকে বুঝতে পারছি মেয়েটা অবিবাহিত। আর বাচ্চাটা তার আপন বড় বোনেরই মেয়ে। সাথে অবনিতার বাবা মাও আছেন। তাঁরা বাজার করতে গিয়েছেন বলে, ছয় কেজি মিষ্টির বড় বোঝার মতোই অবনিতা ও তার বোনপোকে মিষ্টির দোকানে রেখে গেছেন। হয়তো যাবার সময় তাঁরা মিষ্টির মতোই অবনিতাকে প্যাকেটজাত করে অথবা আমার দশাধিক জামা কাপড়ের মতোই বোগলদাবা করে নিয়ে যাবেন। এমা! এতবড় ধন্বি মেয়ে কী বোগলদাবা করা যায়? আমার জানা নাই। ভগাই ভালো জানেন। 

আমি তখনও সেফায়েতের জন্য অপেক্ষায়। কারন সেফায়েত এখনও এসে পৌঁছায় নি। আমি হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম একবার। এমন সময় অবনিতার বাবা ও মা এসে উপস্থিত। অবনিতার মা আমাকে প্রাথমিক ভাবে দেখেই যেন আশ্চর্য হবার মতোই কিছু মনে করলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। আর অবনিতা তার বাবা মাকে পেয়ে যেন রেগেমেগে আগুন। 

বাজারে এতসময় কি করছো? 

মাঃ কত কিছু কিনলাম। সময় তো একটু লাগবেই। 

কোন কমনসেন্স নাই তোমাদের। তোমরা থাকো, আমি চললাম। 

মাঃ মনোজকে (অটো গাড়ির ড্রাইভার) একটু ফোন কর। দেখ, গাড়ি নিয়ে শহরে আছে কিনা। 
তুমিই করো। আমি চললাম। 

অবনিতা তার মাকে যতই ঝামটি মারুক, তবুও মনোজকে ফোন করলো। মনোজ শহরে নেই। অবনিতা অন্য একটা গাড়ি রিজার্ভ করে ব্যাগ, মিষ্টি, আনাচপাতি নিয়ে গাড়িতে উঠলো। 

তারা সবাই রৌদ্রজ্বল আলোর সামনে থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি মিষ্টিশপে দেখা অবনিতাকে নিয়ে এতটা লিখছি, ওর নামকরণ করেছি এর কারণ ওই একটাই। আমি আবারও বলছি, মেয়েটা আশ্চর্যজনক সুন্দরী। যে রুপের উপমার কোন রুপরেখা নাই। তার সৌন্দর্যের প্রশংসা না করলেই নয়। বিদ্রোহী কবি নজরুলও সুন্দরের প্রশংসা করতেন। আমি করলে দোষ কী? নজরুল লিখেছিলেন, 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কী মোর অপরাধ।' আমি কবি নই। লিখতে পারি না। লিখতে পারলে আমিও হয়তো কবির মতোই দুই কলম নতুন কিছু লিখতাম, 

'হাত বাড়িয়ে দিয়েছি প্রিয়, তুমি মন বাড়িয়ে ছুঁইও। 
অবনিতাই নও শুধু তুমি,তুমি টগর,চামেলি,জুঁইও।'

সেফায়েত যখন সাতক্ষীরায় এসে পৌঁছলো, তখনও আমি ওখানেই বসা। সেফায়েত আমাকে দেখে অবাক হয়। সে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলে, বন্ধু মনে আছে, অনার্সে পড়াকালীন সময় প্রতিদিন আমি যখন তোকে প্রাইভেটে ডাক দিতাম, তখন তুই থাকতি মেসের বাথরুমে। আমি ওর মুখের কথা থামিয়ে ওকে মিষ্টি খাওয়ালাম। কিছুক্ষণ খোঁশগল্প করলাম। শেষ পর্যন্ত সেফায়েতের সাথে কথা শেষ করে আমিই তাড়াতারি উঠে দাঁড়ালাম। হাতে বহু কাজ জমাট বেঁধে আছে। তবুও আমি চুল দাড়ি কেটে জামাকাপড় ইস্ত্রি সেড়ে, জুতায় কালি করে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন বেলা একটা। 

এত ব্যস্ততার কারণ একটাই। বিকেলবেলা ঘটকমশাই ব্যস্ত হয়ে আছেন আমাকে একটা মেয়ে দেখাবেন বলে। বিকেল তিনটায় আমাকে চৌরাস্তার মোড়ে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। মূলত ব্যস্ত হবার কিছু না। আবার ব্যস্ততাও কম না। ছোটখাটো যাই হোক চাকরি যখন নিজের মাথার উপর একটা রয়েছে, সেখানে বাড়তি ছুটি নাই বললেই চলে। শুক্র শনি দুইদিন যদিও আমার ছুটি, কিন্তু এই মেয়ের পড়াশুনা ঢাকায়। সে ঢাকা ভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। পরীক্ষা শেষে বাড়িতে এসেছে। দুই একদিন থেকেই চলে যাবে। তাছাড়া মেয়ের মা সন্ধ্যার পর মেয়ে দেখাতে চাচ্ছেন না। বৈদ্যুতিক আলোতে নাকি মেয়েদের লাবণ্যতা হারায়। এমন নানান মুনির নানান অযুহাতে আমার আজকের এই ব্যস্ততা। 

আমি প্রতিদিনের মতোই ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে যাই মেয়ে দেখতে। ঘটক একটা মোটরসাইকেল নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন চৌরাস্তায়। আমি সে মোটরসাইকেলে বসতে না বসতেই গাড়িতে টান। এমা্, পরে যাচ্ছিলাম তো! তবু আমাদের গাড়ি থামলো না। সামনের কোন হার্ডব্রেকে আমি ঠিক হয়ে বসলাম। গাড়িটা আশির বেগে ঘন্টাখানেক চলার পর আমরা পৌঁছলাম মেয়ের রান্নাঘরের বাঁকে। আমরা নামলাম। গাড়ির ড্রাইভার চলে গেল চায়ের দোকানে। আমরা পৌঁছে গেলাম কন্যাগৃহে। 

বিকেল পাঁচটা। সন্ধ্যা সহ্নিকটে। মেয়ের বাবা বাড়ির ভেতরেই আছেন। হয়তো কোন কাজকর্ম করছেন। মেয়ের মায়ের ছোট ছোট কথা শোনা যাচ্ছে ঘরের ভেতর থেকে। এদিকে কর্তৃপক্ষ এক ষোড়শী বালিকাকে নিযুক্ত করলেন আমাদের অভ্যার্থনা কক্ষে। পরিচয় পর্বে জানতে পারলাম এই ষোড়শীই মেয়ের ছোট বোন। মেয়ে দেখাতে কোনক্রমে রাত করবে না বলেই, সে আমাদের খাবার পরিবেশন করে মেয়েকে নিয়ে আসা হলো আমাদের সন্মূখে।

এই মুহুর্তে ঘর থেকে মেয়েকে বের করার সময় মেয়ের পা দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য রকম সুন্দর সে পা। ছোটবেলা মা বলতেন 'লক্ষীরপা' ঠিক যেন এই মেয়ের পা সেই লক্ষীর পা। এবার মেয়ের পা ছাপিয়ে তার নীল রঙের ল্যাহেঙ্গার কভার দেখা যাচ্ছে। এভাবেই আস্তে আস্তে পুরো মেয়ে। 

মেয়েকে দেখে আমি পুরোপুরি অবাক হোলাম। নিজের হাতে নিজে চিমটি কেঁটে স্বপ্ন নাকি বাস্তব একবার চেখে নিলাম। হ্যাঁ, আজকের এই ঘটনা প্রবাহের সবটুকু বাস্তব। এতক্ষণে মেয়ে আমাদের সামনের চেয়ারে বসে মিষ্টি হেসে আমাকে প্রশ্ন করল, কেমন আছেন? আমাকে চিনেছেন?
- আপনাকে না চেনার দুঃসাহসী বিস্মৃতি আমার এখনো হয় নি।
তবে কী আপনি কোন কারনে বিচলিত? 
- না না। আমি মোটেই বিচলিত নই। (এমন সময় ভেবেছিলাম প্রশ্ন করবো, আপনার নাম কি? কিন্তু এর মধ্যেই মেয়েটি আমাকে আবার প্রশ্ন করল।) 
সকালবেলা আমার কি নাম রাখলেন ?
- অবনিতা।
অবনিতা? অর্থাৎ পৃথিবী? 
- হ্যাঁ। কিন্তু আমি আপনার নাম রেখেছি জানলেন কেমন করে? 
মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা আমার। কতদূর কী শিখতে পেরেছি! তাই একবার ঝালাই করে দেখলাম।  
কোন প্রশ্ন করবেন? 
- হ্যাঁ, না। আমতা আমতা সুরে। 
কেমন লেগেছে আমায়? 
- মিষ্টি খাবো। 
আপনি অপেক্ষা করুন, আমি সাতক্ষীরার ঘোষ ডেয়ারিটা, অবনীতাময় কোন একটা প্লেটে ঢেলে দিচ্ছি। 
- আপনার আমাকে ভালো লাগে নি? 
একটা মিষ্টি দুইজনে খেলে কী আপনার কোন আপত্তি আছে?
- কিন্তু মিষ্টি তো ছিল ছয় কেজি।
আপনি দুষ্টু একটা। সে আমি সকালবেলা দেখেই বুঝেছি। বাবা মা আসছেন। আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(0)

গল্প পড়ুন, গল্প লিখুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার গল্প তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
CLOSE