একাত্তরের জলছবি



নন্দিনী আরজু রুবী


স্বাধীন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রেললাইনের ওদিকটায় ঘাসের জমিতে ছাগল বাঁধা আছে। বৃষ্টি এসে গেলে ভিজে যাবে, তাড়িয়ে আনতে হবে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো, মেঘ ক্রমশ বেড়ে উঠছে,ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে এই  বৃষ্টি এলো বলে।
স্বাধীন এ গাঁয়েরই মেয়ে বয়স বায়ান্ন, সবাই তাকে এক ডাকেই চেনে। যুদ্ধের বছর পাকবাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের ফলে --তার জন্ম। লোক মুখে শুনেছে, যুদ্ধে তার বাবা শহিদ হয়েছেন । সেই ছোটবেলায় মাকেও হারিয়েছে। মায়ের কোনো স্মৃতি তার মনে নাই,শুধু তার দেওয়া স্বাধীন নামটা মানুষের মুখে মুখে আজও। এখনো পুরানো দিনের মানুষেরা সেই সব যুদ্ধ দিনের কথা মনে রেখেছে।বাঙালির বীরত্ব গাঁথা ভয়াল সেইসব দিন-রাতের কথা। মৃত্যু নির্যাতন রক্তে রঞ্জিত জন্মভূমির মাটি। ক্ষতবিক্ষত লাশ সেইসব কালো ইতিহাস। বছর ঘুরে ছাব্বিশে মার্চ আসে  বিজয়ের বারতা নিয়ে,
এইসব দিবসে এখনো তার ডাক পড়ে স্মরণসভা র‍্যালি কত অনুষ্ঠান  আয়োজন ! 
এসব স্বাধীনের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আনে না। তার দিন কষ্টে আর পরিশ্রম করেই কাটে। তার কোন খেদ,  অভিযোগ বা নালিশ কিছুই নাই। তার জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রামও থেমে নাই। শৈশব থেকেই নানা ঘাতপ্রতিঘাত, প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে আছে সে। নামে মাত্র বিয়ে হয়েছিল, বেশি দিন টেকেনি সংসার। কোন সন্তানাদি নাই, বিয়েও আর করেনি। অন্যের বাড়িতে কাজ করতো এখন বয়স বেড়েছে,  আর পারে না। কষ্টের সঞ্চয় দিয়ে দুইটা ছাগল কিনেছে।
সামনে হাটবার সেটাও বিক্রি করে টিন কিনতে হবে।  ঘরের জীর্ণ খড়ের চালার দিকে তাকিয়ে মনটা দমে  গেলো তার।পচে গেছে একেবারে।চালা ছাইতে না পারলে আসছে বর্ষায় মাথা গোঁজার উপায় থাকবে না। এখন কেউ কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না, কারো সাহায্যেও কেউ এগিয়ে আসে না।
এক ফোঁটা বৃষ্টি তার মুখে পড়তেই আনমনা স্বাধীনের ভাবনায় ছেদ পড়লো।সে তাড়াতাড়ি পা চালায় রেললাইনের দিকে, ট্রেন আসারও সময় হয়ে গেছে। আগে আগে তাড়িয়ে আনতে হবে ছাগল, নাহলে ভিজতে হবে। 
        
স্বাধীনের জীবন যাপন দূরহ হয়ে উঠেছে। সব জিনিসপত্রের আকাশ ছোয়া দাম। সে কিছু রিলিফের চাল পায় আর শাকপাতা দিয়ে  কোনোমতে দিন চলে যায় তার। বয়স্কভাতা  কার্ড করে দেবে আশ্বাস দিয়েছেন মেম্বার। এতো দিন এসবের তোয়াক্কা করেনি সে। এতিম খানার পাশদিয়ে যাওয়ার সময় ভাবলো ভাতা পেলে কিছু টাকা এখানে দেবে। এতিম শিশুদের দেখলে তার খুব মায়া হয়। সবার মুখে হাসি দেখতে পেতো যদি! 
        স্বাধীন জানে সেটা হবার নয়, নিজের জীবন দিয়ে  বুঝেছে।তাকে দেখতে পেয়ে নাবিল ডেকে বললো,
" মেঘবৃষ্টি মাথায় করে কোথায় চললে গো দাদি?"
"লাইনের ওপার থেকে ছাগল আনতে রে...।"
"বৃষ্টি তো এলো বলে! আমি আসবো তোমার সাথে?"
"না না তুই ভিজে যাবি, আসতে হবে না।" 
নাবিল এই গ্রামেরই ছেলে। মা ছোট রেখে মারা গেছিলো, বাবা গেলো বছর ট্রাক চাপা পড়ে মারলো।গরীব মানুষ সব, আত্মীয়রা কেউ ওর দায়িত্ব নেয়নি। বছর সাতআট বয়স এখন ঠাঁই হয়েছে এই এতিমখানায়। স্বাধীন প্রায় সময় পেলে এখানে আসে, সবার খোঁজ খবর নেয়।এতিম বাচ্চাগুলোর সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে।সবাই স্বাধীনকে খুব ভালোবাসে।সে এখানে অতৃপ্ত মাতৃত্বের স্বাদ পায়,সবাইকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসে।
 
                   রেল লাইন ধরে তাড়াতাড়ি পা চালায় স্বাধীন, জোর হাওয়া দিচ্ছে ধুলো উড়ছে। অনেক দিন এই লাইনে তার যাতায়াত বেশ কিছু দূর এগোলেই স্টেশন। লাইনের ওপারে বাঁধা ছাগলদুটো চিৎকার শুরু করেছে। একটা দুটো বড় বড়  বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। স্বাধীন ভাবলো , নাবিলকে সঙ্গে আনলে বড় ভালো হতো,দৌড়ে গিয়ে ছাগলের দড়ি খুলে আনতে পারতো।  তাড়াহুড়োয় দড়ি খুলতেই ছাগলের টানাটানিতে পা দড়িতে পেচিয়ে গেলো , ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো সে,পা ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে  স্বাধীন! ছাগল দুটো বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে টানছে শুধু ... 
রক্ত বেরুচ্ছে কিন্তু ছাড়াতে পারলো না সে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো লাইনের উপরে। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো। জোর বাতাসে গাছের পাতা ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ছে। দূরে ট্রেনের হুইশেলের শব্দ, ট্রেন আসছে ... 
মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ধেয়ে এলো ট্রেন,মেঘের বিকট শব্দ বাজ পড়লো কোথাও। বৃষ্টি শুরু হলো। প্রাণপণ চেষ্টায় চিৎকার করে উঠলো কিন্তু শব্দে ঢাকা পড়ে গেলো...  
       অসহায় সে স্থানুবৎ তাকিয়ে রইলো,হাঁচড়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো বাতাসে তার সবুজ শাড়ি উড়ছে ঝাপসা ধূসরতার ভিতর ড্রাইভার শেষ মুহুর্তে তাঁকে দেখতে পেলো, বড্ড দেরি হয়ে গেছে তখন...
      একটা ঝটকায় স্বাধীনকে গুড়িয়ে দিয়ে পেরিয়ে গেলো ট্রেন। বোবাকান্নায় পৃথিবী যেন থমকে গেলো। ভিজছে প্রাণী, মানুষ আর প্রকৃতি... সকরুন হায় জীবনের অধ্যায়। 
বৃষ্টির জলে রক্ত মিশে জমা হচ্ছে, সবুজ শাড়িতে রক্ত ক্রমশ বৃত্ত তৈরি করছে, পতাকার মতো। রক্তশূণ্য মুখটা সাদা শাপলার মতো বৃষ্টির পানিতে ভাসছে। দুটি হাত মুঠিবদ্ধ, জীবন যুদ্ধ আর সংগ্রামের স্বাক্ষর সব থেমে গেছে।
       বন্ধ চোখে দীর্ঘ ইতিহাস একাত্তর থেকে বাইশের পৃষ্ঠা নিথর। ক্ষণজন্মের পঙ্কিলতা ধুয়ে রক্তস্রোতে একটা নির্মল জলছবি হয়ে উঠলো  স্বাধীনের অক্ষত বৃষ্টি ধোয়া মুখ.....।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(0)

গল্প পড়ুন, গল্প লিখুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার গল্প তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
CLOSE