গল্প, প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে

প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে ......
 ডাঃ উজ্জ্বল ঘোষ, মৌলাশোল |

 নেপুরার  কাছে ঝিঁকু নদীর বাঁকে তখনও আঁধার নামেনি   | জামদার ঘাটে একদল ছেলে খেলা করছে | নিঃসঙ্গ এক বৃদ্ধ হেঁটে চলেছে |  পরনে হাঁটুর ওপরে খাটো করে পরা ময়লা ধুতি | গায়ে হাতা ওয়ালা ছেঁড়া মলিন গেঞ্জী | বাঁ কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর এক হাতে বাঁশের লাঠি | কেমন যেন উদাস  একটা ভাব | 

 বিকাশ জিজ্ঞেস করে "কোথায় যাবেন? "
বৃদ্ধ কাঁপা গলায় বললেন .." ব্যাঙদা ....I"
"আপনার বাড়ী কোথায়?"
"ওই গাঁয়েই রে বাপ ....  ......ঠিক ঠাউর করতে পারছি নাই  কনদিকে রাস্তাটা | অনেকদিন আগে বৌ টার সাথে ঝগড়া করে রাগ করে ঘর ছাড়্যেছিলম | তখন গায়ে বল ছিল | কাজ কম্ম করে ভালই ছিলম  | এখন আর পারছি নাই রে বাপ ... মাঝে মাঝেই শরীর টা খারাপ হচ্ছ্যে | "

একটু দুরেই দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলেন এক বৃদ্ধা | একটু আগেও আপন মনে হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙছিলেন | এই বৃদ্ধের সাথে কথা বলতে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন | এখানেই একদিন পাথর ভাঙতে ভাঙতে স্বামী স্ত্রীতে তুমুল ঝগড়া বাঁধে | তারপরেই বেপাত্তা স্বামী | সে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা | 

এই তিরিশ বছরে নিজের শরীর খারাপ , বন্যা আর খুব আবহাওয়া খারাপ ছাড়া একদিনও পাথর ভাঙা ছাড়েনি বুড়ি | ওটাই ওঁর বেঁচে থাকার রসদ | অপেক্ষার প্রহর গোনার  সাথে জীবন জীবিকার নীরব কাহিনী | বুড়ি জানে তার প্রানের মানুষ একদিন ফিরে আসবেই | 

লোকে কতও  বলেছে...."ব্রাহ্মন  ডেকে  শ্রাদ্ধ করে  দে! এতোদিন কি আর কেউ  বেঁচে থাকে! আর বেঁচে থাকলে ঠিক ফিরে আসতো | তাছা়ড়া বিধবা ভাতাটা পেলে আর এই বয়সে এতো খাটতে হতো না l"

বুড়ি কারো কথা শোনেনি  | আজোও কাঁপা কাঁপা হাতে সিঁথিতে সিন্দুর পরে বুড়ি | মায়ের জেদকে  ভালো চোখে নেয়নি ছেলেরা | ওয়ারিশ সার্টিফিকেট না বের করতে পারার কারনে যেটুকু জমি জায়গা সবই তো বাপের নামে | তাই অবাধ্য মাকে ছেড়ে  তারাও বৌ বাচ্চা নিয়ে নিজের মতো করে আছে | 

আজ এতোদিন পর জামদার ঘাটে সন্ধ্যার আকাশে বুড়ি একসাথে চাঁদ ও সূর্যকে দেখতে পাচ্ছে!

এই কি এই তার স্বামী সূর্য সর্দার! 

হ্যাঁ,ওই তো সে বলছে ..... ... "সূজ্জু সদ্দার  আমার নাম | ঠিক ইখেনটাই আমার বৌ টার সঙে গন্ডোগোল লাগ্যে ছাড়ে চলে গেছলম বাপ  | এখন বৌ টার কথা দমে মনে পড়ে | কুথায় আছে, ক্যামন আছে? কে জানে! "

বুড়োটার কথা শুনে বুড়ির বুকের ভেতরটা আনচান করে ওঠে |  আর থাকতে পারে না | সেই একই ঢং কথা বলার | তিরিশ বছরে একটু বদলায় নি কথার ভঙ্গিমা | বুড়ি নিশ্চিত এই তার বেপাত্তা হওয়া স্বামী | অতঃপর দৌড়ে  বুড়োর  কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে পা জড়িয়ে ধরে | বুড়োও জড়িয়ে ধরে বুড়িকে | আজ আনন্দ  অশ্রুর প্লাবন  নদীর বুক জুড়ে |

বিকাশ  চোখের সামনে বুড়ির ভালোবাসার গভীরতা অনুধাবন করার শুধু চেষ্টা করে  |

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(0)

গল্প পড়ুন, গল্প লিখুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার গল্প তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
CLOSE